রক্তাক্ত ১০ই নভেম্বর ৮৩

রক্তাক্ত ১০ই নভেম্বর ৮৩

লেখকঃতাতিন্দ্র লাল চাকমা(পেলে)

 

[তথ্যবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ এই লেখায় এম.এন লারমাসহ আটজন সহযোদ্ধা শহীদ হওয়ার সময়ের ঘটনাটি উঠে এসেছে। যারা এখনো লেখাটি পড়েনি তাদেরকে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে পুরো লেখাটি পড়ার অনুরোধ রইল। ]

 

সেই এক হৃদয় বিদারক, বিভীষিকাময় ঘটনা, উদ্বেলিত হৃদয়ের রক্তকণিকা খসে পড়া একটি মুহুর্ত…।

 

অসংখ্য তারকাখচিত উদার আকাশ থেকে হঠাৎ যদি কোন উল্কাপিণ্ড খসে পড়ে মানুষের চমক লাগার মত কিছুই নয়; কিন্তু উজ্জ্বল শশীকলার আলোর বন্যায় যদি রাহুগ্রাসে হঠাৎ বিষাদের কালো ছায়া নামে তাহলে সারা দুনিয়ার মানুষ ব্যথিত ব্যাকুল ও হতচকিত না হয়ে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে যেমনি রয়েছে সেই অতি শোকাবহ ও বিষাদের কালো দিন, তেমনি রয়েছে আমাদেরও।

 

জাতীয় অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আমরাও জুম্ম জনগণ করে যাচ্ছি প্রতিবাদ, পাশবিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর ষড়যন্ত্র ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছি প্রতিরোধ।

 

তাই স্বভাবতই যাবতীয় অত্যাচারী শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারী ভণ্ডামীই হয়েছে আমাদের শত্রু। সেই ভণ্ড শত্রুদেরই বিষাক্ত নখের আঁচড়-জাতীয় ইতিহাসের সব চাইতে জঘন্যতম, ঘৃণ্যতম ১০ নভেম্বর – যা গোটা বিশ্বকে করেছে হতবাক আর জুম্ম জাতি হয়েছে সান্ত্বনাহীন ব্যথিত ও শোকাভিভূত।

 

জুম্ম জাতির ইতিহাসে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র (গিরি – ভবতোষ দেওয়ান, প্রকাশ – প্রীতি কুমার চাকমা, দেবেন-দেবজ্যোতি চাকমা ও পলাশ – ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান) একটি কলঙ্ক ও একটি জঘন্যতম ষড়যন্ত্র। অতি শোকাবহ ও মর্মান্তিক ১০ নভেম্বর-এর কালো দিবসের স্মৃতি রোমন্থনের পূর্বাহ্নে জুম্ম জাতির কুলাঙ্গার গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের হীন চরিত্র ও উদ্দেশ্য উন্মোচন করা অপরিহার্য। গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র যদিও দীর্ঘদিন যাবৎ পার্টির পতাকাতলে সমবেত হয়ে কাজ করেছে তথাপি পার্টি নেতৃত্বকে কখনই মেনে নিতে পারেনি। দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালিপ্সা, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, ব্যভিচার, উচ্চাভিলাষ এদের স্বভাব চরিত্রে মজ্জাগত ছিল।

 

অথচ এই কুচক্রীরা শ্রদ্ধেয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে পশ্চাতে ও সঙ্গোপনে অনেক বিরূপ মন্তব্য ও অপপ্রচার যেমন কখনও বলতো ধর্মভীরু, কখনও বা আপোসপন্থী, কখনও বলতো একরোখা, সর্বোপরি তার একনিষ্ঠ ও যোগ্যতর সহকর্মীদের বিশেষত সন্তু লারমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও কুৎসা রটনা করতে বরাবরই প্রয়াসী ছিল। সমগ্র পার্টিতে একটা প্রভাব বিস্তারের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু সামনাসামনি কোন মন্তব্য করার সৎসাহস কারোর ছিল না।

পক্ষান্তরে তারাই উপযুক্ত, তারাই সবজান্তা, তারাই জুম্ম জাতির জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে দাবি করতো নির্লজ্জভাবে। তাই এই নেতত্বকে তারা বিষাক্ত আগাছা বলেই মনে করতো। এ কারণে তারা এই নেতৃত্বের প্রতি তাদেরই মধ্যে গালমন্দ করতো, ঘৃণাভরে ভর্ৎসনা করতো এবং মুখ বিকৃত করে অভিশাপ দিত আর নেতৃত্বের বিষোদগার করতে সচেষ্ট থাকতো। কিন্তু শ্রদ্ধেয় নেতার পিতৃহৃদয় ও বিপ্লবীসত্ত্বা বরাবরই বিশ্বাস করতো – তাদের একদিন না একদিন সুমতি হবে এবং আত্মসমীক্ষা করে একদিন সৎপথে ফিরে আসবে। কিন্তু নেতার এই সহনশীলতা ও ক্ষমাশীল মনোভাবকে তারা দুর্বলতা বলে বিবেচনা করতো এবং পরিশেষে একদিন ক্ষমতা কেড়ে নেবার উন্মত্ততায় ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিল। ১৯৮২ সালের জাতীয় সম্মেলনে তারা সশস্ত্র বাহিনীকে উস্কানী দিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পার্টির সর্বময় ক্ষমতা দখলের এক বিরাট অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু সচেতন কর্মীবাহিনীর সামনে সেসব ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও পার্টি নেতৃত্বে তাদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন পূর্বক পুনর্বার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করে।

 

কিন্তু অবিশ্বাসের ভূত তাদের কায়-মন-বাক্য থেকে কখনই সরে পড়ল না। পুনরায় তারা ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়াতে থাকে। তারা পার্টির অভ্যন্তরে থেকে পার্টির বিরুদ্ধেই স্যাবোটেজ আরম্ভ করে দেয় এবং ভাতে মারা ও পানিতে মারা বিষবাষ্প সৃষ্টি করে। তার ফলে সমগ্র পার্টিব্যাপী এক চরম সঙ্কট ও অচলাবস্তা সৃষ্টি হয়। তারপর একসময় আকস্মাৎ ঘটল বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণে পেটের নাড়িভূড়ি সব বেরিয়ে পড়ল এবং কুরুক্ষেত্রে কলিজা ফাটা আর্তনাদ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হলো। পরিণতিতে চক্রান্তকারীদের সার্বিক অবস্থা দ্রুত ডুবন্ত সূর্যের মতই যখন মুমূর্ষু হয়ে দেখা দিল তখন হন্যে হয়ে সমঝোতার পথ খুঁজতে থাকে। অতপর পার্টি নেতৃত্ব জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ‘ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়া নীতির’ ভিত্তিতে গণতন্ত্রের পথ সুগম করার মানসে এক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু পৃথিবীতে যত ধর্মের কাহিনীই থাকুক না কেন চোররা তা শুনতে কখনই রাজী নয়। তারা আরো নতুন কায়দায় ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে গোপনে গোপনে। সংক্ষেপে এই হলো ১০ নভেম্বরের পূর্বকালীন অবস্থা।

 

এইভাবে চলতে থাকে একদিকে ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে প্রতিরোধ। এমনিভাবে বর্ষা চলে গেল। শরতের আগমন ঘটল। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করতে করতে একদিন শারদীয় নির্মল দিনগুলোও নিরসমুখে বিদায় নিল। চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র তবুও শেষ হলো না। চক্রদের হোতা গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসার কথা ছিল কিন্তু তারা এলো না। একসময় প্রকাশ জানালো সে তার অনুগামীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তাই কেন্দ্রের সাহায্য চেয়ে এক জরুরী চিঠি পাঠালো। অনেকের সন্দেহ হলো সমঝোতায় হয়তো চক্রান্তকারীরা আসতে নারাজ। এ ব্যাপারে নেতার কাছে পরামর্শ চাওয়া হলে শ্রদ্ধেয় নেতা ধৈর্য্য, সহিঞ্চুতা ও দৃঢ়তা নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পরামর্শ দিলেন। তাই তখনকার অস্থায়ী ব্যারাকটা অন্যত্র সরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলো কারণ চক্রদের হোতা গিরি ঐ অস্থায়ী ব্যারাক থেকেই চলে গিয়েছিল।

 

নভেম্বর পয়লা সপ্তাহ। পূর্বের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য রিপ ও সেক্টর কমান্ডার মেজর দেবংশীর নেতৃত্বে বিশ্বাসঘাতক প্রকাশের চিঠি মূলে চক্রান্তকারীদের সাহায্য করতে ও উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে একটা দল বাইরে চলে গেল। হঠাৎ দুই নম্বর সেক্টর থেকে জরুরি ভিত্তিতে খবর আছে যে, চক্রান্তকারীদের জৈনক কমান্ডার তাদের কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে এবং সঙ্গে এ কথাও বলেছে যে, চক্রান্তকারীরা আবারো চক্রান্ত করার পাঁয়তারা করছে।


সপ্তাহের শেষ দিন। শোনা গেল বাংলাদেশ বেতার থেকে খবর পরিবেশিত হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। প্রথমে হুঁশিয়ারি সংকেত, পরে বিপদ সংকেত। এভাবে বিপদ সংকেত নম্বর ৩, ৪, ৫ হতে এক সময় মহাবিপদ সংকেত দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। আমরা ভাবলাম দুর্যোগ বুঝি এখনো কেটে যায়নি। প্রকৃতির এই ভয়ংকরতা ও রৌদ্ররূপ হৈমন্তীর দিনগুলোকেও বুঝিবা রেহাই দিচ্ছে না। আমাদের সতর্কতা আরো বাড়ানো হলো। বিশেষ প্রোগ্রামে শ্রদ্ধেয় লীডার একটু বাইরে গেলেন; কড়া পাহাড়ার মধ্যে তিনি ফিরে এলেন রাত্রে।

 

সেদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে এবং শীতল হাওয়ার শিকার হয়ে লীডার অসুস্থ হয়ে পড়লেন।


নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহ। আবহাওয়া আরো খারাপ হয়েছে। প্রায়ই ঝড়ো হাওয়া এসে গোটা পরিবেশটাকে বিষণ্ণ করে তুলেছে। ডা: জুনির নিরবিচ্ছিন্ন পরিচর্যার সত্ত্বেও লীডার নিরাময় হয়ে উঠতে পারলেন না। রাত প্রায় তিনটে লীডার অসুকে ছটফট করছেন, নিরন্ন মুখে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন। আমরা যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এদিকে সন্তু স্যারও প্রেসিডেন্ট এরশাদের ৩ অক্টোবরের ঘোষণার বিপরীতে খোলা চিঠি লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই আর অস্থায়ী ব্যারাকটা স্থানান্তরিত করা সম্ভব হলো না। নভেম্বর ৯ তারিখ বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কমেছে বটে কিন্তু প্রায় সময়টা জুড়ে বায়ুপ্রবাহ বয়ে চলেছে। সারাক্ষণ কাকের কা-কা রবে প্রকৃতি যেন কিসের এক আশঙ্কায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। বিকেলে লীডারকে কিছু বিস্কুট খাওয়াবার চেষ্টা করা হলো কিন্তু তিনি খেতে পারলেন না। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। সবাই যার যার বিছানায় শুঁয়ে পড়েছে।

 

রাত ৮টা নাগাদ পাশের ঝিরিতে কি যেন একটা গড়িয়ে পড়ার শব্দ শোনা গেল। দু’জন সৈনিক টর্চলাইটের আলো দিয়ে জায়গাটা চার্জ করে এলো। কিছুই দেখতে না পেয়ে প্রকৃতির ঘটনা ভেবে তারাও ঘুমিয়ে পড়লো। রাত ১১ থেকে ১২ টা পর্যন্ত আমরা চার জন প্রহরায় ছিলাম। তখনও প্রায় ভারী শুষ্ক হাওয়া বয়ে চলছিল। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে জোছনার আলো পৃথিবীর সাথে লুকোচুরি খেলছিল। তখন কেই বা জানতো প্রকৃতির মধ্যে কোন বিভীষিকাময় ঘটনা কারোর জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। প্রহরী বদল করে আমরা শুঁয়ে পড়লাম। আমার পাশের সঙ্গীটার সামান্য জ্বর ছিল। অতএব তাকে কোনোরকম বিরক্ত না করে একটু অসুবিধার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

 

১০ নভেম্বর ভোর রাত তিনটে বাজতে তখনও কিছু বাকি। গভীর তন্দ্রা থেকে বিদঘুটে এক স্বপ্নের শিহরণে আমি হঠাৎ জেগে গেলাম। শয্যার উপর বসে চারিদিকে একটু তাকালাম, দেখলাম প্রহরী বদল হচ্ছে। হাতের ঘড়িটা টর্চের আলোতে দেখে নিয়ে আবার গা এলিয়ে দিলাম। ভাবলাম বোধকরি একটু অসুবিধার মধ্যে ঘুমুতে গিয়ে এভাবে দু:স্বপ্নের মধ্যে ঘুম ভাঙলো। তারপর আস্তে আস্তে ঘুমের তন্দ্রা পাচ্ছে। পায়ের কাছে একটু কড়মড় শব্দ হওয়াতে টের পেলাম পিনহোল টর্চের আলো দিয়ে কে যেন বাইরে যাচ্ছে, আর একটু পরেই আকস্মাৎ কারবাইনের ব্রাশ ফায়ার হলো ট-ট-ট-টশ্। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পায়ের দিকের মাটিতে লাইন পজিশন নিলাম। ‘মুই রিপন, রিপন‘ কথাটা শুনতেই তাকিয়ে দেখি রিপনদা ‘ওমা’ ‘ওমা’ করতে করতে উঠানে গড়াগড়ি দিচ্ছেন।

 

কিছু একটু বোধগম্য না হতেই চিৎকার দিয়ে বললাম কি হয়েছে, কি হয়েছে! তখন উত্তরপশ্চিম কোণের পায়খানা ঘরের রাস্তার মুখে (বড় ব্যারাকে একদম সন্নিকটে আমাদের এলএমজি ম্যানের খুব কাছাকাছি) থেকে একজন সোজা দক্ষিণ দিকে লীডারকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত ব্রাশ ফায়ার করছে, অন্যজন আমাকে আর সন্তু স্যারকে লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করে চলেছে। আর বিশ্বাসঘাতকেরা ‘ইয়া আলী…, ইয়া আলী…’ শব্দ করছে এবং অাবুল্যা এডভান্স করে বিকৃত গলার স্বরে শব্দগুলো উচ্চারণ করছে। ততক্ষণে আরো ৪/৫ জন আমাদের ব্যারাকের খুব কাছে (আমার ৫/৬ গজ দূরত্বে) এসে একসাথে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে দিয়েছে। বোঝা গেল চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশ আর্মি ভান করে বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ করতে এসেছে। ট্রেঞ্চে গিয়ে পজিশন নিলাম। সেখানে সন্তু স্যার ও মিহিরদাকে নাগাল পেলাম। ততক্ষণে সেকেন্ড লেফটেনান্ট মণিময় ও কর্পোরেল অর্জুন উত্তর পার্শের ট্রেঞ্চগুলোতে পজিশন নিতে গিয়ে সরাসরি শত্রুদের ফায়ারের মুখে পড়ে ইহলীলা সংবরণ করল। ঐ দুটো অস্থায়ী ব্যারাকে আমরা ২০/২২ জন মানুষ ছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে সব চাইতে অসুবিধার দিকটা ছিল এই যে, শক্ররা রয়েছে উত্তর প্রান্তেভ আর আমরা পজিশন নিতে বাধ্য হয়েছি দক্ষিণ প্রান্তে। মাঝখানে রয়ে গেছে দুটি ব্যারাক ও বাদবাকি মানুষগুলো। তাই বাদবাকি মানুষগুলোর কথা ভেবে আমরা ঠিকমত ফায়ারই করতে পারছিলাম না। কারণ সেই অন্ধকারে কাউকে সঠিকভাবে চেনা যাচ্ছিল না।

 

আমরা অস্থায়ীভাবে তিন ভাগে ভাগ হয়ে অবস্থান করছিলাম। পাহাড়ের সর্বোচ্চ উত্তর দক্ষিণ লম্বালম্বি ব্যারাক, সেখান থেকে ৪০/৫০ গজ নিচে পাহাড়ের মাঝামাঝিতে সামনাসামনি দুটি ব্যারাক। ব্যারাকের পাশে দক্ষিণমূখী হয়ে একজন সেন্ত্রী থাকে। সেখান থেকে ২০/২৫ গজ নিচে ঝরণার কাছাকাছিতে পাকঘর-কাম-ব্যারাক দুটো পাশাপাশি। সেদিন পূর্বমুখী একজন সেন্ত্রী ও উপরের ব্যারেকের উত্তর-দক্ষিণ হয়ে দুটো সেন্ত্রী মিলে সর্বমোট ৪ জন সেন্ত্রী সবসময় থাকতো। কিন্তু শত্রুরা মুহুর্মুহু ফায়ার ও হাত বোমার আওয়াজ করতে করতে মধ্য ব্যারাকের উঠোন বরাবর ও ব্যারাকের নিচে ঢুকে পড়েছিল।

 

উপর্যুপুরি ব্রাশ ফায়ার ও হাত বোমার বিস্ফোরণে মনে হচ্ছিল প্রতিহিংসার উন্মত্ততায় শত্রুরা যেন প্রতিটি ঝোপপাড়কেও ধ্বংস করে দিতে চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ট্রেঞ্চের কাছাকাছিতে দুটো হাত বোমা ফেটে যায় এবং প্রবল গোলা বর্ষণ করতে থাকে। ফিল্ড কমান্ডার সন্তু স্যার উপরে ফাইটিং গ্রুপ নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে সংকেত দিতে সচেষ্ট থাকেন। ইতিমধ্যে কর্পোরেল জাপানকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা ও পার্টির বিভিন্ন ইউনিটের সাথে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদানেও সন্তু স্যার ব্যাপৃত থাকেন। এমন সময় উপর থেকে আমাদের ফাইটিং গ্রুপ এস শত্রুদেরকে পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে। চতুর্দিক থেকে ফায়ারিং আওয়াজ শুনে শত্রুরা মন্ত্রী-মন্ত্রী বলে ডাকাডাকি শুরু করে দেয় এবং কয়েকবার লম্বা লম্বা বাঁশি বাজানোর পর পূর্বদিকে ছড়া (ঝরনা) বেয়ে চলে যায়। কিন্তু ততক্ষণে ৮ জন ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং কর্পোরেল সৌমিত্র ও কর্পোরেল বকুল আহত হন। কিন্তু সৌমিত্র গুরুতরভাবে আহত হয়ে লীডারের জায়গা থেকে সামান্য দূরের ঝোপে আড়াল করা একটি গর্তে নিজেকে কোনমতে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হন। তিনি আহত অবস্থায় দুইদিন বেঁচে থাকেন।

 

তাঁর প্রত্যক্ষ বিবরণ থেকে জানা যায় – লীডার প্রথমে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। কিন্তু অসুস্থ শরীর ও দুর্বলতা হেতু সরে যেতে পারেননি। শত্রুরা ব্যারাকের ভিতরে ঢুকে লীডারকে আহতবস্থায় দেখতে পায়। তখন লীডার হত্যাকরীদের সাথে কথা বলার সুযোগ পান। লীডার প্রথমে বলেন – ‘কি, তোমাদের ক্ষমা করে আমরা অন্যায় করেছি? আমাকে কিংবা তোমাদের বন্ধুদের মেরে জাতি কি মুক্ত হবে? যাক, তোমরা প্ররোচিত ও উত্তেজিত হয়ে যাই করো না কেন জাতির দুর্দশাকে তোমরা কখনো ভুলে যেও না আর জাতির এ আন্দোলনকে কখনো বানচাল হতে দিও না।’ লীডারের কথা শুনে উপস্থিত দু’জন বিভেদপন্থী নীরবে চলে যায়। তারা আর ফিরে আসেনি। ততক্ষণে তাদের মধ্যে কড়া ভাষায় কথা কাটাকাটি হতে শোনা যায় এবং সন্ত্রস্ত কণ্ঠে ‘ও যেদং ভিলে, যেদং’ শব্দ শোনা যায়। সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে কে একজন এসে লীডারের গায়ে উপর উঠে কোন কথা না বলে ব্রাশ ফায়ার করে দ্রুত পালিয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পরেই ঐ জায়গাটি আমাদের পুনর্দখলে আসে এবং সমস্ত শত্রুদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মীরা এসে শ্রদ্ধেয় লীডারের বুক জড়িয়ে ধরে এবং আবেগাকুল ও উদ্বেলিত কণ্ঠে বলতে থাকে – ‘স্যার, ও স্যার আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না। তুমি ছাড়া আমি কোথায় থাকবো স্যার।’ শ্রদ্ধেয় লীডারের বুক তখনও উঞ্চ ছিল। তিনি কোনমতে চোখ মেলে তাকালেন এবং হাত দিযে কি যেন সান্ত্বনা দিতে চাইলেন কিন্তু কোন কথা বেরুল না, কোন অশ্রু ঝরলো না। শুধু বুকের তাজা রক্ত বিছানা গড়িয়ে টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়তে লাগলো। তারপর চোখ খোলা রেখে লম্বা এক বুকভরা শ্বাস নিয়ে অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় চিরশায়িত হয়ে রইলেন। নির্মম এই পৃথিবী যিনি নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত জাতির সেবায় নিজের শেষ রক্ত বিন্দুটুকুও দান করে গেলেন সেই জাতি তাদের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূতকে এক ফোঁটা ঔষধ খাওয়াবার সুযোগ পেল না।

 

তাঁর স্বাভাবিক উজ্জ্বল চেহারা তাঁর খোলা চোখ যেন তিনি এখনও স্বাভাবিক। দেখে মনে হয় মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও কোন প্রকার ভয়ভীতি তাঁকে যেমন ছোঁয়াতে পারেনি, তেমনি জন্মভূমির মায়া, প্রকৃতির আলো বাতাস দু’চোখ ভরে দেখার স্বাদ এখনো মিটেনি। উত্তপ্ত রক্ত প্রবাহের বিদ্যুৎ খেলানো শান্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা শত্রুকে তাড়া করে ফিরে এসেই জিজ্ঞেস করে স্যার কোথায়? যখন দেখে স্যারের নিষ্প্রাণ দেহখানি পড়ে রয়েছে তখন আর কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারে না। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে ‘শেষ.., সব শেষ চক্রান্তকারী গুণ্ডারা আজ স্যারকে হত্যা করে আন্দোলনকে ধ্বংস করলো। তোমাদের একদিন এই পাপের প্রয়শ্চিত্ত করতে হবে।’

সেদিনের কান্না প্রিয়নেতাকে হারানোর ব্যথা, চিরবঞ্চিত দৃষ্টিশক্তিকে হারানোর চাইতেও গভীর ও মর্মন্তুদ। যে মানুষটি জুম্ম জাতির মুক্তি কামনায় বছরের পর বছর কঠোর সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন, যে বিপ্লবী কণ্ঠ ছিল দুনিয়ার সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার সেই অগ্রনায়ক, জাতির কর্ণধার, জাতীয় চেতনার আলোকবর্তিকা যেন তার সমস্ত সলিতা বিসর্জন দিয়ে নিজের দায়িত্ব সমাপন করলেন। কিন্তু জাতিকে তার আরো অনেক কিছু দেবার মত ছিল।

 

সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে…, হৃদয়ের গভীরতম আবেগে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রয়েছে দেখে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। অশ্রু মুছে নিলাম। সান্ত্বনা দেবার জন্য কিছু বলতে যেয়েই কণ্ঠরোধ হয়ে এলো বিধাতা সেদিন বাকশক্তিকে কেড়ে নিয়েছেন। সমস্ত দেহটা অবসন্ন বোধ করছি। মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো। মিহিরদা সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন – ‘যা হবার তো হয়েই গেছে সেটা ফেরাবার আর নেই। তোমরা ধৈর্য্য ধরো। আর আহত সৌমিত্রকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।’ অবশেষে সমস্ত শক্তি দিয়ে আত্মসংবরণ করলাম। লীডারের গোছানো জিনিসগুলো এক জায়গায় জড়ো করে প্রয়াত নেতার মরদেহের উপর কাপড় জড়িয়ে দিলাম। কিন্তু মুখ ঢেকে দেবার সাহস হলো না। যেই মুখ উগ্র ধর্মান্ধ স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার ও উগ্র বাঙালি মুসলমান জাতীয়তাবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দু্র্গ গড়ে তুলেছিল, সেই অভূতপূর্ব মুখখানি ঢেকে দিতে সাহস হলো না।

 

সেদিনের আকাশ ছিল মেঘলা, মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া এসে সমস্ত পরিবেশটাকে স্যাঁতস্যাঁতে করে রেখেছিল। ব্যারাকের সমস্ত জিনিসপত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো। উঠানে ও মেঝেতে হাত বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত কালো দাগগুলো সমস্ত পরিবেশটাকে কলুষিত করে রেখেছিল। বেপরোয়া গুলির আঘাতে সমস্ত কাপড়-চোপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে এলোপাতাড়ি পড়ে রয়েছে; ইতস্ততভাবে গোলাগুলি পড়ে রয়েছে। ব্যারাকের ভিতরে লাশ, উঠানে লাশ, রাস্তার উপরে লাশ সবাই যেন বিছানাহীন শয্যায় অনাদরে লুটোপুটি দিচ্ছে। আমরা সব মরদেহগুলো এক জায়গায় জড়ো করে কাফন মুড়িয়ে দিচ্ছিলাম। দেখতে পেলাম চক্রান্তকারী শত্রুরা ঐ মরদেহগুলোর উপর অহেতুক গুলি বর্ষণ করে তাদের প্রতিহিংসার ঝাল মিটিয়েছে। পাষণ্ডতার এই কুলক্ষণ উন্মত্ত পাগলা কুকুরকেও অনায়াসে হার মানিয়ে দেবে।

তখনও বাতাসে সর্বত্রই পোড়া বারুদের উগ্রগন্ধ। প্রকৃতির বিমর্ষতাও যেন নাছোড়বান্দা। মৃদু সঞ্চারমান মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কখনও এক ঝলক রোদ এসে ধরণীর অশ্রু মুছিয়ে দেবে এটুকু ক্ষীণ আশাও সেদিন ছিল না। মাননীয় ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমা মিহিরদাকে আহতদের চিকিৎসার ভার দিলেন। আশেপাশের সমস্ত এলাকা চার্জ করে দেখার নির্দেশ দিলেন আমাদেরকে। তার পরদিন অন্যান্য সব ইউনিটগুলোতে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে দ্রুত খবর পাঠানোর ব্যবস্থা নিলেন এবং ঔষধ সংগ্রহের জন্য লোক নিয়োগ করলেন। ইতিমধ্যে দু:সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে বন্ধু-বান্ধবরা দলে দলে এস ভীড় জমাতে শুরু করছে। সবাই প্রয়াত নেতাকে শেষবারের মত দেখতে চায়। অবশেষে সন্তু স্যার এসে পৌঁছালে উপস্থিত লোজনদের প্রিয়নেতার শেষ দর্শনের অনুমতি দিলেন।

 

ব্যারাকের ভিতরে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। একজন বৃদ্ধ লোক এসে প্রয়াত নেতার কাফন খুলে দেখলেন। তার গুলিবিদ্ধ ঝাঁঝড়া বুক দেখে আস্তে ধীরে বসে পড়লেন এবং কপালে হাত রেখে অশ্রুসিক্ত বিস্ফোরিত নয়নে বিলাপ করতে শুরু করলেন- ‘হে দেশমাতৃকার প্রকৃতি সন্তান! আমরা জানি শত প্রলোভন তোমাকে মোহিত করতে পারেনি; একটা আগ্রাসী জাতির যাবতীয় হুমকি তোমাকে বিচলিত করতে পারেনি; তোমাকে মানসিক দৃঢ়তায় কোনদিন ভাটা পড়তে দেখিনি। তোমার স্বার্থত্যাগ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তোমার প্রেরণায় গোটা জাতি আজ বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে সাহসী হয়েছে। তবুও তোমার শত্রুরা জাতির কুলাঙ্গারেরা তোমাকে হত্যা করলো।’

 

তিনি ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। সবাই অশ্রু সজল নেত্রে একবাক্যে বলে উঠলাম – সত্যিই বিনা মেয়ে বজ্রঘাতের মতই হয়েছে। সবাই বলে উঠলো – হে ভগবান, তুমি এই খুনীদের, এই বেঈমানদের বিচার করো। জনতার সারি থেকে আরো একজন বৃদ্ধ এসে অশ্রু মুছে নিয়ে প্রয়াত নেতার কপালে হাত রেখে বুদ্ধ ধর্ম সংঘ বলে আশীর্বাদ দিতে দিতে বললেন- ‘তুমি তো যেখানেই যাও না কেন সবসময় ‘সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্ত’ (সকল প্রাণী সুখী হোক) বলে ধর্মীয় বাণী প্রচার করতে, কতবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কাজ করতে দেখেছি, কাউকে তুমি হিংসা করো না। তুমি স্বর্গবাসী হবে; পরিনির্বাণ লাভ করবে। কোন প্রাণীকে তুমি হত্যা করতে না। তোমার এই সৎকর্মের ফল ইহকালে না হলেও পরকালে ভোগ করবে।’

 

উপস্থিত জনতা সবাই সমস্বরে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো – ‘শান্তিবাহিনী ভাইয়েরা, মূর্খ শিষ্যের চেয়ে পণ্ডিত শত্রুও ভালো। গৌতম বুদ্ধের এই উপদেশটা কখনও ভুলে যেয়ো না। যারা মূর্খ, যারা বেঈমান তাদেরকে ক্ষমা করার কোন দরকার নেই।’

 

ততক্ষণে আশেপাশে বাহিনীর সকল সদস্যগণ এসে জড়ো হয়েছেন। সবাই পুরো ব্যাপারটা জেনে নেবার জন্য নানা প্রশ্ন করছেন। পরে উপস্থিত জনতা সরে গেলে প্রিয়নেতার বিদেহী আত্মার প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শনের জন্য নীরবে অশ্রুসিক্ত নয়নে ব্যারাকে উঠে এসেছেন। এভাবে কর্মীরা যখন আসতো প্রিয়নেতা তাড়াতাড়ি এসে অভ্যর্থনা জানাতেন। সবার সাথে করমর্দন করতেন এবং আন্তরিকভাবে আলিঙ্গন করতেন। তারপরে তাঁর পাশে বসিয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়ে পড়তেন। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর কুশলবার্তা ও পরিস্থিতির খবরাখবরগুলো অতি নিখুঁতভাবে জেনে নিতেন। তাঁর এ বিনয়ী মনোভাব, মহানুভবতা ও স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। পার্থিব জগতের দু:খ বেদনা অভাব অভিযোগ সব কিছুই ভূলে যেত তাঁর এই অমায়িক ব্যবহারে। তাঁর সাথে আলাপ করে প্রত্যেকটি কর্মী নতুন প্রেরণা লাভ করে উজ্জীবিত হয়ে ফিরে যেত। কিন্তু এই দিনের কত কর্মী এসে জড়ো হয়েছে সে প্রেরণা কেউ পেল না। কারো সাথে করমর্দন হলো না, কাউকে আলিঙ্গন করলেন না। তিনি রয়েছেন তারই প্রিয় বিছানায় নির্বিকার চিত্তে; চিরশায়িত হয়ে। কোন রকম উত্তেজনা, কোন রকম শোকার্ত কান্না তাঁকে আর বিচলিত করবে না।

 

সবাই ধীরে ধীরে তাঁর শবদেহের পাশে হাতিয়ার রেখে দুই হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে কৃত্জ্ঞতার সাথে সম্মান জানাচ্ছে, কেউ কেউ দু’পায়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করছেন – স্যার, তুমি আর আদর করবে না স্যার? তুমি কি আলাপ করার জন্য আর কাছে ডাকবে না স্যার! হায়রে অবুঝ হৃদয়! এতকিছু দেখেও বিশ্বাস করতে পারছো না?… তবুও তো বাস্তবতাকে মানতে হয়। তারপর কয়েকজন মিলে আমরা তাঁর জিনিসপত্রগুলো তদন্ত করে দেখলাম। অনুসন্ধান করে দেখা গেল, চক্রান্তকারী শয়তানেরা প্রিয় লীডার ও সন্তু স্যারের যাবতীয় দলিলপত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্রাদি প্রায়ই লুঠ করে নিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেশ কয়েকখানা হাতিয়ার গোলাবারুদসহ অন্যান্য অনেকেরই জিনিসপত্রাদি নিয়ে পালিয়ে গেছে। অবশিষ্টাংশের মধ্যে দেখতে পেলাম তাঁর ব্যবহারের একটি কেটলি, একটা পানির কন্টেনার ও একটা পানির চোঙা তখনও পানি ভর্তি অবস্থায় পড়ে আছে। তাঁর ব্যবহারের জন্য মাত্র দুটো কম্বল, একটা গিলাপ কাপড় যা দিয়ে বালিশ বানানো, একটা পেন্ট, একটা শার্ট ও এক জোড়া মোজা পায়ে জড়ানো। তাছাড়া বহু পুরানো এক জোড়া জুতা, একটা পুরানো গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি ও একটা দেশীয় ঝোলা রয়েছে।

 

ফেলে যাওয়া তাঁর সুটকেসটা খুলে দেখা গেল – অনেকগুলো বই, কিছু ঔষধ, একটা ডায়েরি ও একটা ছোট ফটো এ্যালবাম ও শিষ কলম কয়েকটা। দেখলাম তাঁর ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা আছে ‘মহান জুম্ম জনগণের আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক, সারা দুনিয়ার নিপীড়িত জনগণ এক হও। জয় আমাদের হবেই-হবে।’ তাঁর প্রিয় ডায়েরির সাথে আরো রয়েছে অনেকগুলো পেপার কাটিং সেগুলো তিনি খুবই সযত্নে সংরক্ষণ করতেন। সংস্কৃতিবান ও ছিমছাম জীবনের অধিকারী প্রিয়নেতার এ্যালবাম দেখা গেলো – তাঁর অতি প্রিয় দু‘টি সন্তানের ছবি, তাছাড়া ছাত্র ও শিক্ষক জীবনের এবং এলএলবি পাশ করে এডভোকেট হওয়াকালীন তোলা সযত্নে রাখা ফটো। তাঁর সেই ছবিগুলো দেখে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে প্রথম দেখা স্মৃতিগুলো আমাকে মনে করিয়ে দিল।

এছাড়া আরো অনেকগুলো ফটো একের পর এক করে দেখছিলাম তখন হঠাৎ একজন নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠলো – ‘এমনিতে এ স্যার অতিরিক্ত দয়ালু। কি প্রয়োজন ছিল এই চক্রান্তকারী শত্রুদের ক্ষমা দেয়ার।’ সে কথা শুনে অন্য একজন তাড়াতড়ি বলে উঠলো – ‘দেখ ভাই ভূল ধরলে অনেক কিছু পারা যায়। নেতার মহৎ হৃদয়কেও দোষ দেয়া যায়। কিন্তু তাঁর এই ক্ষমা গুণ না থাকলে এতক্ষণে আমাদের কার কি অবস্থা হতো ইয়ত্তা আছে? তাঁর মতো মহৎ হৃদয় না থাকলে আমাদের শাস্তি পেতে পেতে মাথার চুলও চলে যেত। কত ধৈর্য ধরে তিনি আমাদেরকে বার বার বুঝাতেন, শিখাতেন তাঁর সূক্ষ চিন্তাধারা। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি না থাকলে আমাদের এ জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটতো না, জুম্ম জাতি এতক্ষণ ধ্বংস হয়ে যেতো।’

 

এসব কথা শুনে ঔ দলের কমান্ডার বলে উঠলেন – ‘দেখ ভাইয়েরা, আমাদের এই মহান নেতার অবদান ও মহত্ব তাঁর শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারবে না। তিনি খাঁটি বৌদ্ধ। তোমরা তো নিজেরাই জান তিনি একটা পিঁপড়েকেও মারতে দিতেন না। ঘাটের চিংড়ি ও কাঁকড়াগুলোকে মারতে দিতেন না বলে ওরা আমাদেরকে ভয় করতো না, পায়ের কাছে কাছে এসে আহার যোগাড় করতো। দেখ দয়া করলে পশুপক্ষীরা পর্যন্ত পোষ মানে। আজ নেতার মৃত্যুর মাধ্যমে জাতি তার সবচাইতে সম্মানিত সম্পদটাই হারালো। এ ক্ষতি কোনোদিন পূরণ হবার নয়। তাঁর আন্দোলনের জ্ঞান, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম, আইন ইত্যাদি সর্বজ্ঞানে গুণান্বিত মানুষ জাতি আর কোনোদিন পাবে কিনা সন্দেহ। তোমরা দুর্বল হয়ো না ভাইয়েরা, বাস্তব জগত থেকে তাঁর অস্তিত্ব মুছে যেতে পারে কিন্তু তাঁর অবদান ও তাঁর অমরবাণী আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এসো ভাইয়েরা নেতার মরদেহ ছুঁইয়ে আমরা নতুন করে শপথ নিই এই মহান নেতার স্বপ্ন আমরা পূরণ করবোই। সবাই একসাথে বলে উঠলো – ‘জনসংহতি সমিতি জিন্দাবাদ, শান্তিবাহিনী জিন্দাবাদ, জুম্ম জনগণ দীর্ঘজীবী হোক। প্রিয়নেতার ঐতিহাসিক অবদান অমর হোক, অমর হোক।’

 

দেখতে দেখতে দিবসের শেষ ভাগ নেমে এলো। বিকেল ৫টা বেজে আরও গড়িয়ে গেছে। উপস্থিত জনতা ও বাহিনীর সদস্যরা মিলে মরদেহগুলো দাহন করার ব্যবস্থা নেয়া হলো। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের কোণ ঘেষে আঁকাবাঁকা হয়ে ছড়া (ঝর্ণা) চলে গেছে। ছড়ার দু‘ধারে মাথা উঁচু উঁচু করে দাঁড়ানোর তরুরাশির ছায়াই বহুলতাগুল্মের ঘেরা একটুখানি সমতল জায়গা। ঐ জায়টায় সাফ করে মরদেহগুলোর সমাধি বানানো হয়েছে। তারপর এক এক করে মরদেহগুলো শ্মশানে নিয়ে আসা হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে আসা হলে মেজর পেলের নেতৃত্বে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা ও উপস্থিত জনতা সবাই প্রথমে লীডারের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেন এবং পরে অন্যান্যদেরকেও করা হয়। তারপর জনতার পক্ষ থেকে অন্যান্য মরদেহগুলোর পরিচয় করিয়ে দেবার অনুরোধ জানানো হয়। তখন দলের পক্ষ থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন সদস্য শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জানিয়ে দিলেন এইভাবে – এই হচ্ছেন আমাদের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত জুম্ম জনগণের নেতা লারমা। যিনি জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণ এনে দিয়েছেন। যিনি জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। দশ ভাষাভাষী জুম্ম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জুম্ম জাতির জাগরনের অগ্রদূত, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, চিন্তাবিদ, নিপীড়িত মানুষের একনিষ্ঠ বন্ধু, মহান দেশপ্রেমিক ও রাজনীতিবিদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি দিয়ে গেছেন মুক্তির মন্ত্র। ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের নেতা লারমা ভদ্র, বিনয়ী, ক্ষমাশীল, স্নেহবৎসল, অতিথিপরায়ণ, সুশৃঙ্খল, কর্তব্যনিষ্ঠ, সদালাপী ছিলেন। তিনি বিবাহিত। তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা। শোক সন্তপ্ত তাঁর পরিবার পরিজনের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। মেজর পরিমল বিকাশ চাকমার মরদেহ হচ্ছে এটি। ছাত্র অবস্থা থেকে তিনি বিলুপ্ত প্রায় জুম্ম জাতির কথা ভাবতেন। তাই ছাত্র জীবন থেকেই তিনি দেশ সেবায় আত্মনিমগ্ন ছিলেন। কলেজ জীবন শেষ করার পরই তিনি সক্রিয়ভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি একজন অতি বিশ্বস্থ, সৎ, বিনয়ী, সাচ্চা দেশপ্রেমিক ছিলেন। দীর্ঘ এক যুগ ধরে তিনি প্রয়াত নেতার পাশে পাশে নিরাপত্তা ও সেবা শুশ্রূষার দায়িত্বভার নিজেই বহন করতেন। শত্রুরা সর্রপ্রথম তাঁর উপরেই গুলি বর্ষণ করেছিল। তিনি সদ্য বিবাহিত ছিলেন।

 

এই হচ্ছেন শুভেন্দু প্রভাস লারমা (তুফান)। তিনি প্রয়াত নেতার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই। মাত্র গতকাল তিনি প্রয়াত নেতার অসুখের খবর শুনে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। যুব সমিতির তিনি একজন আঞ্চলিক পরিচালক ও আঞ্চলিক কমিটির একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য। জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এপর্যন্ত তিনি একনিষ্ঠার সাথে পার্র্টি প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ও জনদরদী মানুষ। তাঁর অঞ্চলে অনেক মানুষকে তিনি নিজের সম্পত্তি দিয়ে নিজের শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। চক্রান্তকারী পলাশের ভাইদের যাবতীয় পড়াশুনার ভার তিনিই বহন করেছিলেন। কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাস সেই পলাশ চক্র তাঁর মরদেহের উপর অহেতুক গুলি বর্ষণ করে সারা দেহখানি ঝাঁঝড়া করে দিয়ে গেছে। তিনি বিবাহিত। স্বীয় পত্নী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে রেখে তিনি শহীদ হয়েছেন।

 

তারপরেই গ্রাম পঞ্চায়েৎ বিভাগের সহকারী পরিচালক অর্পণা চরণ চাকমার (সৈকত) মরদেহখানি সকলের সামনে খুলে ধরলেন। সে সময় তাঁর পরিবারের আত্মীয় স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর ডান চোখের ভ্রুতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তাঁকে দেখার সাথে সাথে তাঁর শোক সন্তপ্ত পত্নী, দুই ছেলে ও এক কন্যা হো-হো করে আর্তনাদ করে উঠলো। পিতৃহারা সন্তানেরা মায়ের বুক ছেড়ে বুক ফাটা ক্রন্দনে বাপকে ধরতে চায় – ধরণীর বুকে স্বামীহারা স্ত্রী, পিতাহারা সন্তানদের করুণ আকুতি দেখে মুর্ছাহত হয়ে পড়ে। এই মর্মভেদী দৃশ্য দেখে উপস্থিত লোকজন তাদেরকে বোঝাবার ভাষা হারিয়ে তারাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মা ও ছেলেমেয়েদের অবস্থা দেখে বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মীটি অস্থির হয়ে পড়েন এবং কোন মতে আত্মসংবরণ করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলেন, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত মানুষ। খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে লাঞ্চিত ও ধৃত হন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন দেশপ্রেমিক। একনিষ্ঠ, বিশ্বস্থ ও সুদ্ধিদীপ্ত এই বিপ্লবী বিচক্ষণতা ও যোগ্যতার সাথে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব এযাবৎ সুষ্ঠুভাবে পালন করে গেছেন। রাঙ্গামাটি শাহ্ হাই স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় থেকে তিনি জুম্ম জনগণের জাতীয় সংগ্রামের মহান কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়েন এবং পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলনে একজন পরামর্শদাতাও ছিলেন। তিনি সবসময় বৌদ্ধ ধর্মের নীতির সাথে দলীয় নীতির সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করতেন। আজ তাঁরই স্ব-বান্ধবের সাথে মিলিত হবার কথা ছিল। কিন্তু সে মিলয় আর হলো না। সমস্ত আত্মীয়-পরিজনদের সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করছি।

 

কল্যাণময় খীসা (জুনি) ছিলেন হাসিখুশি স্বভাবের। পিতার একমাত্র সন্তান। তিনি গ্রাম পঞ্চায়েত বিভাগের আঞ্চলিক পর্যায়ে সহকারী পরিচালক ছিলেন। তৎপরে পার্র্টির আর্মোয়ার বিভাগেরও একজন সহকারী ছিলেন। তাঁর ডাক্তারী ও সেলাই কাজে অভিজ্ঞতা ছিল। ততক্ষণে তাঁর স্ত্রী পুত্রকন্যারা তথায় উপস্থিত হওয়াতে পরিস্থিতি আরো ঘনীভূত ও মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। শুধু ভগবানের নাম ডেকে উচ্চস্বরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাঁর অসহায় পত্নী ও স্বজনেরা। এ হৃদয়ের রক্ত শুকিয়ে যাওয়া কান্নায় সারা সমাধিক্ষেত্র মুহূর্তেই করুণ আর্তনাদে ভরে যায়। এই মর্মভেদী কান্নার মধ্যেই সন্তু স্যার বললেন – ‘মা বোন বাপ ভাইয়েরা, আপনারা ধৈর্য ধরুন, বাস্তবতাকে মেনে নেবার চেষ্টা করুন।’ মৃদুভাষী, বিনয়ী, একনিষ্ঠ ও সরল মনের অধিকারী শহীদ জুনি মৃত্যুর আগেও প্রয়াত নেতাকে সেবা করে তাঁর স্বদেশপ্রেম, ধৈর্য ও সৎ মনোভাবের পরিচয় দিয়ে গেছেন। আমরা আজ এ মুহূর্তে অশ্রুজলে ও মনের কৃতজ্ঞতায় তাঁকে বিদায় দেব।

 

এই হচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ অনার্স কোর্সের ছাত্র সৎ, সাহসী ও একনিষ্ঠ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মনিময় দেওয়ান (স্বাগত) যিনি শত্রুর চোখে ধূলো দিয়ে বার বার পার্র্টিকে শত্রুর অনেক গোপন তথ্য সরবরাহ করেছিলেন। পার্টি তথা গোটা জাতি এই জন্যে উপকৃত হয়েছিল। তিনি ছিলেন বর্তমান জুম্ম ছাত্র সমাজের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু এবং শান্তিবাহিনীর একজন বীরযোদ্ধা। শত্রুর বিরুদ্ধে ও দু:সাহসীক কাজে তিনি ছিলেন পারদর্শী ও সুচতুর। শত্রুরা তাঁকে আটক করে নানাভাবে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও দুর্জয় মনোভাবের কাছে সে সবই পন্ড হয়ে গিয়েছিল। তিনি যুব সমিতি ও ছাত্র সমিতির একজন সহকারী পরিচালক ছিলেন। দু:সাহসী এই তরুণ যোদ্ধা চক্রান্তকারীদের মারাত্মক আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে আজ মরেও অমর হয়ে রইলেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর এই মহৎ কৃতিত্ব আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

 

একজন সংঘটক ও কৌশলীকর্মী হিসেবে সুপরিচিত এই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অমর কান্তি চাকমা (মিশুক)। তিনি একজন ভদ্র, বিনয়ী, একনিষ্ঠ, সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে দুই নম্বর সেক্টরের একজন জোন কমান্ডার হিসেবে আরএম জোনের যাবতীয় বিশৃঙ্খল ও জটিলতাকে পার্র্টি অনায়াসে সামলে উঠতে পেরেছিল। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে তিনি খবর পেয়েছিলেন তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। তাঁর একমাত্র নবজাত সন্তানের মুখ দর্শনে বঞ্চিত হয়ে তিনি এই চক্রান্তকারীদের গুলিতে শহীদ হলেন। সদ্য প্রসূতা স্ত্রী তাঁর স্বামীকে হারিয়ে কী নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাবেন তা আজ আমাদের ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। তাঁর স্ত্রী ও নবজাত শিশুকে আমরা আন্তরিক সমবেদনা ও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি।

 

সব চাইতে নিরীহ ও সরল প্রাণের অধিকারী কর্পোরেল অর্জুন ত্রিপুরা। তাঁর একনিষ্ঠ অধ্যবসায় ও সাহসীকতার কারণে অল্প সময়ে তিনি বাঘের মতই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চক্রান্তকারীদের উপর। মৃত্যুর আগে তিনি বিধবা মায়ের জন্য কিছু কাপড় জোগাড় করে রেখেছিলেন। চিরদু:খিনী তাঁর মাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য চিঠি লিখেছিলেন। তিনি একজন সৎ, সাহসী, একনিষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর মাতৃ ভালোবাসা ও বীরত্বপূর্ণ সাহসীকতাকে আমরা গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। কমান্ডার অর্জুনের জীবন প্রদীপ আজ নিভে গেছে বটে কিন্তু তাঁর ত্যাগ, সাহসীকতা আমাদের সংগ্রামের পথে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

 

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। করুণ ও বেদনাঘন পরিবেশে সবাই আগুনের কুণ্ডলী হস্তে ধারণ করে দাঁড়িয়েছেন। শ্রদ্ধেয় সন্তু স্যার লীডারের মরদেহের পায়ে মাথা রেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেছেন। সকলেরই মন ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছে; তবুও তো দিতে হবে বিদায়। মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা, মানুষের প্রেমপ্রীতি মায়া মমতা তাঁর সমস্ত হৃদয়ের আকুতি দিয়ে প্রিয়জনদেরকে ধরে রাখতে চায় -তবু তো যায়না রাখা। …তাঁরপর সবাই চিতায় অগ্নি সংযোগ করতে এলো। হে অগ্নিকুণ্ড! তুমি দ্বিধা হয়ো না। তোমার শক্তি দিয়ে এই বিদেহী পবিত্র আত্মাগুলো তুমি বরণ করে নাও। দেখতে দেখতে আগুনের প্রলয় শিখা দুম দুম শব্দে সব কিছুকে গ্রাস করে নিল। আমরা দেখতে পেলাম চির বিদায়ী অভিসংবাদিত নেতার দক্ষিণ হস্ত অর্ধ চন্দ্রাকারে উত্তোলিত হয়েছে যেন আগের মতই তাঁর সর্বশেষ নির্দেশ আমাদেরকে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এবার আর সেই অনলবর্ষী ভাষায় নয়, শুধু হাতের ইশারায়…। হতভাগ্য জাতির স্বপ্নের একটি দেদীপ্যমান প্রদীপ উজ্জ্বল নক্ষত্র, যে নিজের আলো বিকিরিত করে জাতির তন্দ্রা ভেঙেছে, বেঁচে থাকার বাসনা জাগিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস দিয়েছে, বাস্তবে তিনি আর নেই। কিন্তু থাকবে তাঁর অমর বাণী, সেই সংগ্রামী সোপান, যে সোপান বেয়ে জাতি তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।

 

তারও দু’দিন পর বলীষ্ট ও সুঠাম দেহকে বিদীর্ণ করা তিনটা গুলির আঘাতে সীমাহীন ভোগের পর মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে কর্পোরেল সৌমিত্রের জীবণ প্রদীপ নির্বাপিত হয়ে গেল। তিনি ছিলেন সাহসী ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক। অপার মাতৃস্নেহের লালিত কমান্ডার সৌমিত্র ছিলেন মায়ের পুঞ্জীভূত স্নেহের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। দুর্যোগপূর্ণ দিন গুলোতে তাঁর মায়ের করুণাসিক্ত হৃদয় পুত্র দর্শনের জন্য বড্ডো ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। তাই ঠিক হয়েছিল তিনি নিজে এসে প্রিয়তম সন্তানের মুখ দর্শন করে বিদগ্ধ হৃদয়কে প্রশমিত করবেন; ছেলেকে সোহাগ করে অন্তরের সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে যাবেন। কিন্তু চক্রান্তের এই বিভীষিকা উত্তপ্ত মাতৃ হৃদয়কে করে দিয়েছে আরো হাহাকার, ফেলে দিয়েছেন সীমাহীন শোক সাগরে। মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তে এই অদম্য দেশপ্রেমিক সন্তান মায়ের কথা তুললো না, কারোর জন্য কাঁদলোনা, করলনা কোন অভিযোগ। মুমূর্ষ অবস্থায় শুধু বলে গেল – ‘দেশপ্রেমিক ভাইয়েরা, তোমরা দমে যেয়ো না সত্য ও ন্যায় হচ্ছে আমাদের পথ। জয় আমাদের হবেই। জয়, জ-য়, জ…।’

 

১০ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, একটা বিশ্বাসঘাতকতা, একটা ষড়যন্ত্র, কয়েকটা হাত বোমা ও কয়েক হাজার বুলেটই হলো নির্যাতিত, নিপীড়িত জুম্ম জাতির ইতিহাসে কলঙ্কিত উপকরণ। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত এই চক্রান্তকারীরা পাক-ভারতের মিরজাফর এবং লঙ্কার বিভীষনকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস তার আপন গতি থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। জাতীয় চেতনা কখনো ধ্বংস হতে পারে না। এই নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে চক্রান্তকারীরা ভারিক্কী চালে ও দম্ভভরে পদচারণ করেছে। হম্বিতম্বি করে, লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে নিজেদের সাফাই গেয়েছে আবেগে ভরা উন্নাসিকতায়। কিন্তু সর্বত্রই নেতার হত্যার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে; বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।

 

স্বার্থ ও ক্ষমতার সংঘাতের ফলে ঐ চক্রান্তকারী কতিপয় নেতা সদলবলে সশস্ত্রভাবে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পার্র্টির প্রচণ্ড আক্রমণে বিশৃঙ্খল ও হতাশাগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যকার অন্তর্দন্দ্ব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দলীয় কোন্দলে বিশ্বাসঘাতক দেবেনের অপমৃত্যু তাদের মধ্যকার অন্তুর্দ্ব‌ন্দ্ব তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে। সে সময়ে পার্র্টি উপর্যুপুরি প্রচন্ড আঘাত দিচ্ছে যার ফলে চক্রান্তকারীরা হতাশায় জর্জরিত হয়েছে এবং তাদের মধ্যকার অন্তর্দন্দ্ব বেড়ে গিয়েছে। নিজের দলীয় লোকদের হাতে দেবেনের মৃত্যু ঘটনায় তাদের অভ্যন্তরস্থ এই অন্তর্দ্বন্দের ভয়াবহ রূপ আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। অতঃপর ষড়যন্ত্রের এই কালো হাত এবং রাজনৈতিক ব্যভিচারিত্বকে জুম্ম জনগণের চিনতে আর বাকি থাকেনি। জনগণের ধিক্কার পেয়ে তারা এখন বন্ধ্যা, পঙ্গু ও ব্যভিচারের বার্ধক্য অবস্থায়।

যে ক্ষমাশীল অগ্রদূত শুধু খাল খনন করে নয় উপরন্তু ঝর্ণা বানিয়ে জলপ্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম, জাতির সেই কর্ণধারকে চক্রান্তকারীরা বারুদ ভূষণে ভূষিত করতে পারে বটে; কিন্তু গোটা আন্দোলনের মরিয়া প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আভ্যন্তরীণ দুর্ধ‌র্ষ নদী প্রবাহ বালুকাময় পাড়কে ভাঙতে পারে কিন্তু প্রস্তুরীভূত নদীর পাড় সেই ভাঙনকে অবশ্যই রোধ করতে পারে। ১০ নভেম্বরের শহীদদের পবিত্র রক্তধারাকে স্বাক্ষী রেখে সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রামী ইতিহাস আপন গতিতে চলবে আর সেই সাথে শ্রদ্ধাচিত্তে চলবে জুম্ম জাতির করুণ মর্মবেদনাকে বয়ে নেয়া অন্তসলিলা ফল্গুধারা।

 

প্রথম প্রকাশঃ
‘১০ই নভেম্বর ৮৩’ স্মরণে স্মরণীকা ১৯৮৪

ছবিঃ “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত। 

বিদ্রঃ লেখাটি Kamal Bikash Chakma ফেইসবুকের পোস্ট থেকে সংগ্রহ করেছি। লেখাটি  অত্যন্ত মূল্যবান। ফেইসবুক হয়তো ডিলিট করে দিতে পারে। তাই এখানে কপি করে রাখলাম। এটি কারো লেখা হলে এবং স্বত্বাধিকারের প্রশ্ন থাকলে দয়া করে [email protected] ইমেইল করুন। মন্তব্য ঘরে ও লিখে আমাকে জানাতে পারেন। তবে লেখাটি ‘১০ই নভেম্বর ৮৩’ স্মরণে স্মরণীকা ১৯৮৪ বলে মনে হচ্ছে। 

 

ধন্যবাদ। 

Share the Post:

Recent Posts